পুরুষরা নির্যাতিত হলে লজ্জায় মুখ খোলেন না। পুরুষ ‘উঁচু জাত’, তার ওপর নির্যাতন অত্যন্ত লজ্জাজনক। জানাজানি হলে সম্মান নষ্ট হবে, পুরুষের দুর্বলতা প্রকাশ পাবে। এটিই হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব। অত্যাচার যে কেউ করতে পারে এবং অত্যাচারী যে কেউ হতে পারে। এই সত্যকে মেনে নিলে অনর্থক দম্ভ, গৌরব আর লজ্জা নিয়ে কাউকেই অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে হতো না।
পেশাগত কারণে নারী অধিকার নিয়ে কাজের পরিমাণই বেশি হয়েছে। নারী নির্যাতন নিয়ে প্রতিবেদনের সময় খেয়াল করলাম, নারীকে সুরক্ষা দিতে গিয়ে অনেকটাই কোণঠাসা করা হয় পুরুষকে। যেহেতু বাংলাদেশের আইনের বেশ খানিকটা জুড়ে ধর্মীয় আইনও আছে, উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনে নারীকে পুরুষের চেয়ে খাটো ও দুর্বল করে পুরুষের ওপর কয়েক টন ভারি বোঝা চাপানো হয়েছে এবং নিজের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে পুরুষও সেসব আইনকে মাথায় করে রাখতেই চান, বাধ্য হয়ে তারা এখন এসব আইনের বিরোধিতা করছেন। প্রমাণিত যে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যেসব মামলা করা হয় তার ৮০ শতাংশ মামলাই মিথ্যা। যৌতুক, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা দায়ের করা হলেও এর আড়ালে রয়েছে অন্য ধরনের বিরোধ। নারী ও শিশুদের নির্যাতন থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এ আইন প্রণীত হলেও বর্তমানে প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবেই এর বহুল ব্যবহার। খোদ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও বিভিন্ন মামলায় আদালতের দেওয়া পর্যবেক্ষণ থেকে এমন তথ্য দেখা গেছে।
জমিজমা সংক্রান্ত জটিলতা, পারিবারিক কলহ, দখলদারিত্বসহ নানারকম সামাজিক অপ্রীতিকর ঘটনাকে কেন্দ্র করে অপর পক্ষকে হেনস্তার উদ্দেশ্যে নিজের পরিবারের বা বাইরের যে কোনও নারীকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয় বিরোধীপক্ষকে। জাতীয় একটি দৈনিকের প্রকাশিত কয়েকটি লাইন তুলে দিচ্ছি–
‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারক তাঁর নিবন্ধে বলেন, এই আইনে দায়ের করা মামলার ৮০ শতাংশই যৌতুক-সংক্রান্ত। এর মধ্যে কেবল যৌতুকের দাবিতে মারপিট করে সাধারণ জখম করা কিংবা গুরুতর জখম করা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে যৌতুকের দাবিতে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো মামলার সংখ্যা ৫ শতাংশের কম। তিনি বলেন, তাহলে প্রশ্ন আসে, বাকি মামলাগুলো কি মিথ্যা? এর জবাবে বলা যায়, শুধু যৌতুকের দাবিতে মারধর করে সাধারণ জখম হওয়ার মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও এই মামলাগুলোর ক্ষেত্রে যৌতুকের জন্য মারপিট করার উপাদান অনেক ক্ষেত্রে অনুপস্থিত। তবে এই মামলাগুলো একেবারেই মিথ্যা নয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো কারণে মতের অমিল হলে কিংবা তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া না থাকার কারণে বনিবনা না হলে কিংবা স্বামীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে স্ত্রীর মতামতের পার্থক্যের কারণে পারিবারিক জীবন অশান্তিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী কোনো উপায়ন্তর না দেখে এবং এ-সংক্রান্ত কোনো ফোরাম না পেয়ে বাধ্য হয়ে দ্রুত প্রতিকার লাভের আশায় স্বামীকে এবং তাঁর নিকটাত্মীয়দের আসামি করে এই আইনের ১১(গ) ধারার বিধান অনুযায়ী মামলা দায়ের করে থাকেন।’
এছাড়াও রয়েছে দেনমোহরের মামলা, খোরপোশের মামলা, হয়রানির মামলা ইত্যাদি। তবে এসব মামলার লুপহোলগুলোও পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিষ্ঠা করা। যে নারীকে সারাজীবন ঘরের ভেতর রাখা হয়েছে, বাইরের পৃথিবী যার অচেনা, তাকে তালাকের পর একলা ছেড়ে দিলে আকাশ থেকে মাটিতে পতনের দায় পুরুষতন্ত্রের শক্তিশালী প্রতিনিধি পুরুষকেই নিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। যেহেতু নারী দুর্বল, তার নিজের পায়ের জোর নেই, তাই পুরুষের ওপর আইনের বল প্রয়োগ করে নিজের সুবিধা হাসিল করাকেই অধিকতর সহজ মনে করেন অন্যের মুখাপেক্ষী নারীরা। তালাক হয়ে যাওয়ার পর নাবালক অবস্থায় সন্তান মায়ের কাছে থেকে, বড় হওয়ামাত্রই অভিভাবকত্বের দড়ি বাবার হাতে চলে যাওয়ায় অনেক মা জিদ থেকে খোরপোশের মামলা করেন। মামলা তো করেনই, সন্তানের সঙ্গে বাবার দেখা করাকেও নিষিদ্ধ করে দেন। এখন অভিভাবকত্ব আইন বা খোরপোশ নিয়ে সমতা নিশ্চিত হয় এমন আইন না থাকলে শুধুমাত্র নারীদের দোষারোপ করেও কোনও ভালো ফল আসবে বলে মনে হয় না।
কিন্তু যেসব নারী স্বাবলম্বী, নিজের প্রয়োজনীয় উপার্জন নিজেই করেন, কিন্তু পুরুষ সঙ্গীকে হেনস্তার জন্যই শুধুমাত্র ‘নারী নির্যাতন দমন আইন-২০০০’-এর আশ্রয় নেন, তাদের জন্য বাংলাদেশে বিদ্যমান কোনও আইন নেই। তাহলে আইনের যাঁতাকলে পিষ্ট পুরুষ শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার অপরাধে অপ্রমাণিত মামলার ঘানি কেন টানবেন? সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী’, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে পুরুষকে নির্যাতনের অপ্রমাণিত অভিযোগের বিপরীতে কোনও সুরক্ষা দেওয়া হয় না। ছেলে শিশুদের যৌন হয়রানির শাস্তি আইনে যুক্ত করা, মিথ্যা মামলার জন্য জরিমানার বিধান করা, শাস্তি প্রদানে সমতা আনতে বিধিমালা সুপারিশের গুঞ্জন অনেকদিন ধরে শোনা গেলেও সেটা কোন পর্যায়ে রয়েছে তাও জানা যাচ্ছে না।
নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষদের সুরক্ষাও বিদ্যমান আইনে থাকা উচিত। তবে তার আগে সিস্টেমে সমতা আনতে হবে, সিস্টেমকে সংশোধন করতে হবে। গোড়ায় গলদ রেখে অঙ্কের উত্তর মিলছে না বলে মাথা চাপড়ালে অন্তত আর যাই হোক অঙ্ক নির্ভুল হবে না। পুরুষতন্ত্রের দুর্বলতা, বিদ্যমান আইনে নারী-পুরুষের সমতা বিধান করে পারিবারিক ধর্মীয় আইন বিলুপ্তির পর এক ও অভিন্ন আইন হলে কমবে নারী নির্যাতন, কমবে পুরুষের ওপর আনা মিথ্যা মামলা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে শুধুমাত্র সচেতনতা, শুধুমাত্র এক পক্ষের সদিচ্ছায় কোনও নির্যাতন, কোনও হয়রানি, কোনও মামলা, কোনও অভিযোগ বন্ধ হবে না। নারী কেবলই নির্যাতিত হয় আর পুরুষ কেবলই নির্যাতন করে এবং এটাই সত্য এবং এর অন্যথা হলে লজ্জায় ঘৃণায় মরে যেতে হবে এ জাতীয় স্টেরিওটাইপ চিন্তাভাবনা থেকে বেরোতে হবে আমাদের সকলের। মুখ খুলতে হবে যেকোনও ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন ও হয়রানির বিরুদ্ধে।
লেখক: সাংবাদিক
নোট: ভাল লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না
লেখক: Maruf Hossen Jewel
আমার সাইটঃ MHJ & Associates
নোট: আমাদের ফেসবুক Lawyer's Club Rajshahi পেজ এ লাইক দিয়ে সাথে থাকুন।