অপরের সম্পত্তি প্রতারণা করে নিজ নামে দলিল করে বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনা অহরহই হচ্ছে। আর এতে প্রকৃত মালিককে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে। কিছু অসাধু লোক নানান কৌশলে জাল দলিল সৃষ্টি করে থাকেন।
জালিয়াতির মাধ্যমে কোনো দলিল সম্পাদন করে লোক ঠকানো, প্রতারণা বা অন্যায়মূলক কাজে সহায়তাদান আইনের দৃষ্টিতে একটি গুরুতর অপরাধ। বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি-১৮৬০
এর ৪০৬/৪২০ এবং ৪৬৩ থেকে ৪৭৭ ধারা পর্যন্ত জালিয়াতির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান দেওয়া রয়েছে।
বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধি-১৮৬০
এর ৪৬৩ ধারা অনুযায়ী, জালিয়াতির অপরাধের আবশ্যকীয় উপাদান দুটি-
প্রথমতঃ মিথ্যা দলিল প্রস্তুত করা,
দ্বিতীয়তঃ প্রতারণামূলক ইচ্ছা নিয়ে কোন ব্যক্তিকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে উহা করা।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৭০ ও ৪৭১ ধারার বিধান বলে যে, জাল বা মিথ্যা দলিল হচ্ছে, যে দলিল জাল প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা হয়েছে এবং যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলকভাবে কোনো জাল দলিল জেনে শুনে মূল দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন, তাহলে তিনি দায়ী হবেন এবং দলিল জালিয়াতির অপরাধে দন্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৬৪ ধারায় বলা হয়েছে,––
প্রথমত, কোনো দলিল কিংবা অংশবিশেষ এমন ব্যক্তি কর্তৃক স্বাক্ষরিত, সিলমোহরকৃত বা সম্পাদিত বলে বিশ্বাস জন্মানোর উদ্দেশ্যে, যা প্রকৃত ব্যক্তি কর্তৃক সম্পাদিত হয়নি;
দ্বিতীয়ত, কোন ব্যক্তি কর্তৃক দলিল সম্পাদিত হওয়ার পর প্রতারণামূলক ভাবে বাতিল করে;
তৃতীয়ত, যদি কোনো ব্যক্তি প্রতারণামূলক কোনো মাতাল বা মানসিক বিকারগ্রস্থ ব্যক্তি দ্বারা কোন দলিল স্বাক্ষরিত, সিলমোহর বা পরিবর্তন করান, যা বুঝতে অক্ষম, তা হলে এ ক্ষেত্রগুলোতে দলিল জালিয়াতি করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে।
এছাড়া এই ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি তাঁর নিজ নাম স্বাক্ষর করলেও যদি অন্য ব্যক্তির স্বাক্ষর হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে জালিয়াতি হতে পারে। মৃত লোকের নামে মিথ্যা দলিল প্রণয়ন করা হলে জালিয়াতি হিসেবে গণ্য হবে।
এবার আসুন জাল দলিল কিভাবে সনাক্ত করা যায় তা জেনে নেওয়া যাক-
১। বিক্রেতার কাছ থেকে সব দলিল, বিশেষ করে ভায়া দলিল চেয়ে নিতে হবে। সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে জানতে হবে সব দলিলের ক্রমিক নম্বর, দলিল নম্বর ঠিক আছে কি না।
২। কোনো দলিল নিয়ে সন্দেহ হলে প্রথমে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে দেখতে হবে যে, দলিলটির রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হয়েছে কি-না অর্থাৎ বালাম বহিতে নকলকরন কাজ শেষ হয়েছে কি-না। রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ না হয়ে থাকলে দলিলটি সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে সংরক্ষণ করা মূল দলিলের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে বা জেলা সদরের রেকর্ড রুমে দলিলের প্রকৃতি অনুযায়ী চারটি রেজিস্ট্রার বা ভলিউমে সংরক্ষিত থাকে,উক্ত সংরক্ষণ করা বালাম বহির সাথে দলিলটি মিলিয়ে দেখতে হবে। এ জন্য নির্দিষ্ট ফিস প্রদান করে দলিলটি ‘তল্লাশ ও পরিদর্শনের’ জন্য নির্দিষ্ট আবেদন ফর্মে আবেদন করতে হবে।
৩। সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট দলিলে উল্লিখিত জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। জমিটি যতবার বিক্রি হয়েছে জরিপ খতিয়ানে জমির ঠিকানা ও দাগ নম্বরের পরিমাণ ততবার ঠিক উল্লেখিত আছে কিনা। যদি দেখা যায়, সিএস বা পরবর্তী যেকোনো জরিপের সঙ্গে বর্তমান বিক্রেতার খতিয়ানের কোনো গরমিল থাকলে ধরে নিতে হবে এই জমিতে সমস্যা আছে।
৪। রেজিস্ট্রি অফিস বা ভূমি অফিস থেকে বিভিন্ন সীল জাল করে জাল দলিল তৈরি হলে প্রয়োজনে রেজিস্ট্রি অফিসে বা ভূমি অফিসে গিয়ে বিভিন্ন সীল পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও জালিয়াতি নির্ণয় করা যায়।
৫। একাধিক মালিকের ক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিককে সনাক্ত করতে হবে।
৬। স্বাক্ষর জালিয়াতির ক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
৭। জরিপ খতিয়ানে জমির পরিমাণ পরবর্তী সময়ে যতবার বিক্রি হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কি না, তা যাচাই করুন। দাগ নম্বর, ঠিকানা এসব ঠিক আছে কি না,পরীক্ষা করুন। সংশ্লিষ্ট দলিলে উল্লিখিত জমির মাঠপর্চাও যাচাই করতে হবে। উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে নির্ধারিত ফিস প্রদান করে আবেদনের মাধ্যমে মাঠপর্চা উঠিয়ে যাচাই করা যেতে পারে।
৮। দলিলটি “দানের ঘোষণাপত্র” হলে সেক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার সম্পর্ক যাচাই করতে হবে। এ ধরনের দলিল নির্দিষ্ট কয়েকটি সম্পর্কের মধ্যে হয়ে থাকে। যথা- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, পিতা-মাতা ও ছেলে-মেয়ের মধ্যে, আপন ভাই-বোনের মধ্যে, নানা-নানী ও নাতি-নাতনীর মধ্যে, দাদা-দাদী ও নাতি-নাতনীর মধ্যে। এ কয়েকটি সম্পর্কের বাইরে এই ধরনের দলিল রেজিস্ট্রি হলে তা সঠিক হবে না এবং এ ধরনের দলিল মুলে প্রাপ্ত জমি ক্রয় করা যাবে না। কোনো দান করা জমি হলে দলিলে সম্পাদনের তারিখ দেখে কবে জমিতে গ্রহীতা দখলে গেছে তা যাচাই করতে হবে।
৯। দলিলটি সাম্প্রতিক রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব অ্যাটর্ণি দলিল হলে সেটি নির্দিষ্ট ফরমেটে প্রস্তুত কিনা যাচাই করুন। কারন বর্তমানে ১৯ টি কলামে দলিলটি প্রস্তুতের বিধান রয়েছে।
১০। দলিলে ব্যবহৃত নন-জুডিসিয়াল স্টাম্প সাধারনত সনদপ্রাপ্ত কোন স্টাম্প-ভেন্ডারের কাছ থেকে হয়। স্টাম্প-ভেন্ডারগণ এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রেজিস্টার বহিতে স্টাম্প ক্রেতার নাম লিখে রাখেন এবং স্টাম্পে নির্দিষ্ট নম্বর ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে স্টাম্প-ভেণ্ডারের মাধ্যমে স্টাম্প ক্রেতার নাম ও ব্যবহৃত নম্বর পরীক্ষা করে জাল দলিল সনাক্ত করা যায়।
দেওয়ানী প্রতিকার:
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার-১৮৭৭
এর ৩৯ ধারা অনুযায়ী দলিল বাতিলের মোকদ্দমা করতে হবে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে লিখিত দলিলটি জাল, বাতিল বা বাতিল যোগ্য যা বলবত থাকলে তার গুরুতর ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন অবস্থায় তিনি তা বাতিল বা বাতিলযোগ্য ঘোষণার জন্য সরাসরি দলিল বাতিলের মামলা দায়ের করতে পারেন এবং আদালত তার ইচ্ছাধীন ক্ষমতার বলে তেমন রায় প্রদান করতে এবং চুক্তিটি বাতিল করার নির্দেশ প্রদান করতে পারেন।
দলিলটি বাতিল করতে হলে যে বিষয় গুলো প্রমান করতে হয় তা হলো:
১। দলিলটি জাল, বাতিল বা বাতিলযোগ্য,
২। দলিলটি বাতিল না হলে বাদীর অপূরণীয় ক্ষতির আশংকা,
৩। ন্যায় বিচারের স্বার্থে দলিলটি বাতিল করা উচিত।
সুতরাং, বাদী যদি কোনো সম্পত্তি দখলে থাকাকালীন বিবাদী কর্তৃক বা অন্য কোনো মাধ্যমে স্বত্ব দখল বিহীন অবস্থায় কোনো জাল দলিল সম্পাদন করে প্রতারনার আশ্রয় নেয় তাহলে বাদী সরাসরি ৩৯ ধারা মতে দলিলটি বাতিলের আদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করতে পারে।
অপরদিকে, বাদী যদি ভুয়া বা জাল দলিলের মাধ্যমে সম্পত্তি থেকে বেদখল হয় তাহলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার-১৮৭৭
এর ৮ ধারার অধীন স্বত্বসহ দখলের মামলা করতে পারে এবং আর্জির প্রার্থনায় সময় দলিলটি বাতিল চাইতে পারে। সেই সঙ্গে এই আইনের ৪২ ধারায় পৃথক ঘোষণাও চাইতে পারে।
দলিলটি যথাবিধি রেজিস্ট্রি করা হয়ে থাকলে, আদালতে বিচার শেষে যে রায় এবং ডিক্রি প্রদান করবেন তার একটি নকল সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে প্রেরন করতে হবে। উক্ত রায় এবং ডিক্রি নকলের কপি পেয়ে রেজিস্ট্রার অফিসার সংশ্লিষ্ট বালাম বহিতে দলিল বাতিলের বিষয়টি লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।
জাল দলিল বাতিলে সুনির্দিষ্ট প্রতিকার-১৮৭৭
এর ৪০ ধারা অনুসারে দলিল আংশিক বাতিলের মামলাও করা যাবে। দলিল বাতিলের সঙ্গে সম্পত্তির দখল পাওয়ার মামলাও করা যায়।
তামাদি আইনের প্রথম তফসিলের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাল দলিল তৈরি সম্পর্কে জানার তিন বছরের মধ্যে দলিল বাতিলের মামলা করতে হবে।
জাল দলিল তৈরিকারীদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আদালতে দণ্ডবিধি-১৮৬০
এর ৪০৬/৪২০/৪৬৩-৪৭৩ ধারায় মামলা করা যায়। বিচারক চাইলে সেই মামলা সরাসরি আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে সমন বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দিতে পারেন। তা ছাড়া মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের বিভিন্ন সংস্থার কাছে পাঠাতে পারেন। তদন্তে দলিল ভুয়া প্রমাণিত হলে আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডাদেশ দিতে পারবেন আদালত।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৬৫ ধারায় জালিয়াতির শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি জালিয়াতি করেন, তাহলে ওই ব্যক্তি দু বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ডসহ উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারেন।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৬৬ ধারা অনুযায়ী আদালতে নথি বা সরকারি রেজিষ্টার ইত্যাদিতে জালিয়াতির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বিচারালয়ের নথিপত্র বা মামলার বিবরণী বলে গণ্য কোনো দলিল বা জন্মনামকরণ, বিয়ে বা শবসংক্রান্ত রেজিষ্টার হিসাবে গণ্য বা বা সরকারি সার্টিফিকেট জাল করেন অথবা মামলার কোনো রায়ের কপি জাল করেন, তাহলে দায়ী ব্যক্তি সাত বছর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন। এ অপরাধ জামিনযোগ্য নয়।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৬৭ ধারানুয়ায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি মূল্যবান জামানত, উইল প্রভৃতি জাল করেন,
তাহলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৬৭ ধারার অধীন এ রকম জালিয়াতিতে সহায়তার কারণেও দণ্ডনীয় অপরাধ হতে পারে।
দণ্ডবিধি-১৮৬০ এর ৪৭৪ ধারা অনুযায়ী, ৪৬৬ ও ৪৬৭ ধারার আধীন প্রতারণার উদ্দেশ্যে জালিয়াতির জন্য সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডসহ জরিমানার বিধান আছে।
জালিয়াতির প্রতিকার দেওয়ানি আইনে চাইলে দন্ডবিধি আইনে মামলা চলবে না। একই বিষয়ে দুটি পৃথক আদালতে মামলা-মোকদ্দমা চলবে না। কারণ এতে রেস-জুডিকাটা দোষে মামলাটি বাতিল হতে পারে। তবে জালিয়াতি-সংক্রান্ত কোনো কারণে যদি দেওয়ানি আদালতে দলিল বাতিলসহ স্বত্ব দখলের প্রতিকার কিংবা এ মর্মে ঘোষণামূলক প্রতিকার চাওয়া হয়, তবে ফৌজদারী আদালতে জালিয়াতির সাজা প্রদানের জন্য পৃথক মামলা করা যাবে কি-না, এসম্পর্কে নির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে।
ফৌজদারী কার্যবিধি-১৮৯৮ এর ১৯৫(১) ধারানুযায়ী, কোনো আদালত এমন কোনো অপরাধের প্রতিকার আমলে নেবেন না, যা কোনো দলিল সম্পর্কে কোনো অপরাধ সংঘটিত করেছে বলে অভিযোগ করা হয়, যা কোনো আদালতে বিচারধীন। অর্থাৎ জালিয়াতি সংক্রান্ত কোনো বিচার কার্যচলাকালে আদালতের লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোনো দলিল জালিয়াতি-সংক্রান্ত ধারার অধীন অপরাধের বিচার অন্য আদালত করতে পারেন না।
নোট: ভাল লাগলে অবশ্যই শেয়ার করতে ভুলবেন না